প্রশ্ন-উত্তর

দুরূদ শরীফ পড়ার ফযীলত

Share this

আমরা প্রত্যেকেই এ আশা রাখি যে, আমাদের নামায, রােযা, দান-খয়রাত, আমাদের যাবতীয় ইবাদত আল্লাহর দরবারে কব্‌ল, মাবুল ও মারুর হােক। কিন্তু আমাদের ঈমানও আমলের ত্রুটির কারণে হয়ত তা হয় না।

তাছাড়া কোর্ট-ফি ও সনদপ্রাপ্ত উকীল-ব্যারিস্টারের সই ছাড়া যেমন সাধারণ লােকদের কোন আরবী বিচারকের এজলাসে গৃহীত হয় না, তেমনি সব বিচারকের বিচারক আল্লাহর দরবারেও কোর্ট-ফি ও সনদপ্রাপ্ত ব্যক্তির সুপারিশ ছাড়া কোন দোয়াই ককূল হয় না। আর এ কোর্ট-ফি হচ্ছে দুরূদ শরীফ।

আর সনদপ্রাপ্ত সুপারিশকারী হচ্ছেন, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (ছ)। এজন্য প্রত্যেক প্রকার ইবাদতের আগে-পিছে দুরূদ শরীফ পড়া উচিত নামায হচ্ছে সব ইবাদতের শ্রেষ্ঠ ইবাদত।

এমন ইবাদতের মধ্যে পাছে আমরা ভুলে দুরূদ শরীফ না পড়ি, এজন্য তাশাহহুদের সাথে দুরূদ শরীফ জুড়ে দেয়া হয়েছে। দুরূদ শরীফওঁ তেমনি ইবাদতকে আল্লাহর দরবারে পৌছে দেয়।

তখন আল্লাহ তা’আলা বেছে বেছে শুধু দুরূদসমূহই রেখে দেন , দুরূদ কর্তৃক নীত ইবাদতগুলােও গ্রহণ করেন। এজন্য প্রত্যেক দোয়া, প্রত্যেক ইবাদতের আগে বা পরে দুরূদ শরীফ পড়ে নেয়া উচিত।

তাছাড়া আল্লাহ স্বয়ং আদেশ করেছেন-

অর্থ:-  ও নিশ্চয় আমি আমার ফেরেশতাদেরকে সাথে নিয়ে আমার এ নবীর উপর দুরূদ পড়ি। হে ঈমানদার লােকেরা! তােমরাও তাঁর উপর দুরূদ ও সালাম পাঠ কর। [ সূরা আহযাব- আয়াতঃ ৫৬ ]

এতে প্রমাণ হচ্ছে, নবী করীম (ছ) আমাদের শাফায়াতকারী বলেই শুধু তাঁর উপর দুরূদ পড়া আমাদের কর্তব্য হয়েছে, তা নয়। দুরূদ পড়া আল্লাহরই আদেশ।

দুরূদ শরীফ পড়ার ফযীলত

 (১) হযরত আবু হুরাইরা (রা) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (ছ) বলেছেন- কোন ব্যক্তি যদি মাত্র একবার দুরূদ শরীফ পাঠ করে, তবে একজন ভ্রাম্যমান ফেরেশ্তা আমার দরবারে উপনীত হয়ে খবর দেয়- ইয়া রাসূলুল্লাহ! অমুকের পুত্র অমুক আপনার উপর এত মাের্তবা দুরূদ শরীফ পাঠ করেছেন,

তখন আমিও তার উপর ঠিক তত মাের্তবা দুরূদ পাঠ করি। অতঃপর সেই ফেরেশতা আল্লাহর দরবারে আরবী পেশ করে- হে মাবুদ! অমুকের পুত্র অমুক ব্যক্তি আপনার হাবীবের উপর এত মাের্তবা দুরূদ পাঠ করেছেন।

তৎক্ষণাৎ আল্লাহ তাকে বলেন- উত্তম! কিরামান ও কাতেবীনকে বলে দাও, এ ব্যক্তির প্রত্যেক মাের্তবা দুরূদ পাঠের পরিবর্তে যেন তার আমলনামা থেকে একটি করে গুনাহ কেটে দেয় এবং আমার পক্ষ থেকে প্রত্যেক কাটাস্থানে দশটি করে নেকী লিখে রাখে ।

 (২) আল্লাহর রাসূল (ছ) বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমআর নামাযের জন্য মসজিদে উপস্থিত হয়ে আযানের পর ও খুতবা আরম্ভ হওয়ার আগে চল্লিশ মাের্তবা নিম্নেক্ত দুরূদ শরীফ পাঠ করবে তার চল্লিশ বছরের গুণাহ মাফ হয়ে যাবে। (বুখারী শরীফ)

উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা ছল্লি আলা মুহাম্মাদিনি নাবিয়্যিল উম্মিয়ে ওয়া ‘আলা-আ-লিহি ওয়া আছহাবিহী ওয়া বা-রিকা ওয়া সাল্লিম।

(৩) যদি কেউ উক্ত দুরূদ শরীফ আছরের নামায বাদ একশ’বার পড়েন তবে তার আশি বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যায়। যদি প্রত্যেক জুমআর দিন নামাযের পূর্বে কেউ উক্ত দুরূদ শরীফ এক হাজার বার পড়েন, তবে যতদিন ঐ ব্যক্তি স্বপ্নে তার বেহেশতের বাড়িটি দেখতে না পান ততদিন তার মৃত্যু হয় না। (মুসলিম শরীফ ]

(৪) হযরত আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছ) বলেছেন- ‘কোন ব্যক্তি ওযূ করে আদবের সাথে বসে আমার উপর এক মাের্তবা দুরূদ শরীফ

পাঠ করলে, আল্লাহ তার উপর দশ মমর্তবা দুরূদ শরীফ পাঠ করেন। যদি | কেউ আমার উপর দশবার দুরূদ শরীফ পাঠ করে, তবে আল্লাহ তার উপর। একশ’ বার দুরূদ পাঠ করেন।

যদি কেউ একশ’ বার দুরূদ শরীফ পাঠ করে, তবে আল্লাহ তার উপর এক হাজার বার দুরূদ শরীফ পাঠ করেন এবং তার। জন্য বেহেশত হালাল ও দোযখ হারাম করে দেন।’ [মুসলিম শরীফ)

(৫) রাসূলুল্লাহ (ছ) বলেছেন- ‘আমার সুপারিশের আগে কেউই জান্নাতে। প্রবেশ করবে না কিন্তু যারা আমার উপর সব সময় দুরূদ শরীফ পাঠ করে, তারা আমার সুপারিশের আগেই জান্নাতে চলে যাবে। তাদের জন্য আমার। কিছুমাত্র সুপারিশের প্রয়ােজন হবে না। (মুসলিম শরীফ)

তাসির ও বিনা ওযুতে (পাক শরীরে) দুরূদ পড়েও পুরা সওয়াব পাওয়া যায়; কিন্তু যারা দুরূদ শরীফ পড়ার নিয়তে ওযু করে বসে আদবের সাথে দুরূদ শরীফ পাঠ করেন, তাঁদের মধ্যে খাটি দরবেশ ও কামেল পীর কে, তা চিনতে হলে তিনি যখন মুরিদানকে নিয়ে কোথাও যেতে থাকেন, আপনি তখন পীর সাহেবের পেছনে পেছনে হাঁটতে হাঁটতে গােপনে (নীরবে) দুরূদ শরীফ পড়তে থাকবেন।

যদি তিনি সত্যিকার দরবেশ বা কামেল পীর হয়ে থাকেন, তাহলে কিছুতেই দুরূদ শরীফ পাঠকারীর অর্থাৎ আপনার আগে আগে হেঁটে যেতে চাইবেন না। কিন্তু ভণ্ড দরবেশ ও ব্যবসায়ী পীরেরা টেরই পাবে না- আপনি দুরূদ শরীফ পড়ছেন কি না। আগ্রহ ও প্রয়ােজন মােতাবেক দুরূদ শরীফ নানা প্রকার ।

যে দুরূদে অর্থ যেরূপ, তার আমলের তাসিরও হয় তদ্রুপ। আমরা নিম্নে বিভিন্ন প্রকার অর্থ ও ফযীলতপূর্ণ ৯টি দুরূদ লিখে দিলাম।

উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা ছল্লি-‘আলা- মুহাম্মাদিনি নাবিয়্যিল উম্মিয়ে ওয়া’আলা আ-লিহী ওয়া আছহা-বিহী ওয়া সাল্লিম। অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি আমাদের উম্মি নেতা হযরত মুহাম্মদ (ছ) ও তাঁর পরিবার পরিজন এবং তাঁর সাহাবাদের উপর শান্তি বর্ষণ করুন।

ফযীলত ঃ (১) গাউসুল আযম বড়পীর হযরত আবদুল কাদির জিলানী (র) এর ‘গুনিয়াতুত্তালেবীন’ নামক কিতাবে লেখা আছে, জনাব নবীয়ে দু’জাহান (ছ) বলেছেন-

“যে ব্যক্তি জুম’আ রাতের শেষভাগে দু’রাকআত নফল নামাযে ১ম রাকআতে সূরা ফাতিহা ও আয়াতুল কুরূসী এবং ২য় রাআতে সূরা ফাতিহার সাথে ১৫ বার সূরা ইখলাছ মিলিয়ে নামায শেষ করবে এবং তারপর ১০০০ বার এ দুরূদ শরীফ পাঠ করে নিদ্রা যাবে,

সে রাতে অবশ্যই স্বপ্নযােগে আমার দর্শন লাভ করবে। যদি একদিনে পায়, তাহলে এক সপ্তাহের চেষ্টায় অবশ্যই পাবে।” (২) সাধনগ্রন্থে বর্ণিত আছে- প্রত্যেক ওয়াক্ত নামাযের পর উক্ত দুরূদ শরীফ ১০০ বার ও এস্তেগফার ১০০ বার অজিফারূপে পড়লে পাঠক অবশ্যই স্বপ্নে নবী করীম (ছ) এর দর্শন লাভ করবে।

 জীবিতকালে না পেলে অন্তত মৃত্যুর সময়ে নবী করীম (ছ) এসে সাক্ষাৎ দিবেন এবং তার ইসলামীমৃত্যু হবে।

(৩) রাতে ৩ বার ‘দুরূদে রুইয়্যাতে নবী’ ও ৩ বার এস্তেগফার পাঠ করে নিদ্রা গেলে এ ব্যক্তি কুস্বপ্ন দেখবে না। তদুপরি তার নিদ্রা ভঙ্গের পূর্বেই কুরুণাময় আল্লাহ তার সমগ্র জীবনের গুনাহ মাফ করে দিবেন- যদি তার পাপরাশি দুনিয়ার সমুদ্রসমূহের ফেনাপুঞ্জের সমানও হয়,

কিংবা আলেজ মরুভূমির বালুকাসমষ্টির সমানও হয়, অথবা আরবের রবিয়া-বংশের মেষসমূহের লােমসমষ্টির সমানও হয়। (আল-হাদীস ]

উচ্চারণ ঃ আল্লা-হুম্মা ছল্লি আলা মুহাম্মাদিন খাইরুল খালা-ইকি আফদ্বোয়ালুল বাশারি শাফী ‘ইল উম্মাতি ইয়াওমাল হাশরি ওয়ানারি, মুহাম্মাদি- বি’আদাদি কুল্লি মামি লাকা ওয়া ছল্পি ‘আলা- জামীই আম্বিয়া-ই ওয়াল মুরসালীনা ওয়াল মালা- ইকাতি ওয়া মুকরিবীনা ওয়া

‘আলা- ‘ইবা-দিল্লা-হি ছােয়া-লিহীন। ওয়ারহানা- মা’আহুম্ বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমীন। অর্থ : হে আল্লাহ! আপনার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম মানব হাশরের ময়দানে উম্মতের সুপারিশকারী আমাদের হযরত মুহাম্মদ (ছ) এর উপর আপনার সৃষ্টির সৃষ্ট বস্তুর সংখ্যা পরিমাণে রহমত বর্ষণ করুন এবং আপনার প্রেরিত নবী-রাসূলদের,

নৈকট্যবান ফেরেশতাদের ও আল্লাহর ছােয়ালেহীন বান্দাদের উপর আপনার রহমত বর্ষণ করুন এবং তাদের সাথে আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন। আপনার অশেষ করুণায়, হে সর্বশ্রেষ্ঠ অনুগ্রহকারী আল্লাহ! আপনি আমাদের প্রার্থনা কবুল করুন।

শানে নুযূল ঃ রাসূলুল্লাহ (ছ) এর জীবিতকালে কোন এক অলিআল্লাহ নদীর কূলে বসে বসে উক্ত দুরূদ শরীফ পড়তেন। সেখানকার পানিতে একটি রােগাক্রান্ত মাছ বাস করত। প্রতিদিন শুনতে শুনতে এ দুরূদটি মাছটির মুখস্থ হয়ে যায় এবং মাছটিও তা পড়তে থাকে।

এ দুরূদ পাঠের বরকতে মাছটি সুস্থ হয়ে যায়। তদুপরি এর দেহ স্বর্ণবর্ণ ধারণ করে। ঘটনাক্রমে মাছটি এক ইহুদীর জালে ধরা পড়ে। তা খুবই মুখরােচক হবে ভেবে ইহুদী তাড়াতাড়ি মাছটি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে এবং মাছটিকে উত্তমরূপে ভাজা করার জন্য স্ত্রীকে আদেশ দেয়। ইহুদীর স্ত্রী মাছটিকে বটিতে

ফেলে কাটতে বসে কিন্তু এর একটি কানও কাটতে পারেনি। তারপর আস্ত মাছটিই কড়াইয়ে ফুটন্ত তেলে ছেড়ে দেয়। মাছটি তখন নিরূদ্বেগে সেই ফুটন্ত তেলের ভেতর ঘােরাফেরা করতে করতে উক্ত দুরূদ পড়তে থাকে।

তা দেখে ইহুদী-দম্পতি অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে যায়। তারপর মাছটি নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছ) এর দরবারে চলে আসে এবং সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করে। তাদের কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছ) আশ্চর্য হয়ে যান। তিনি আল্লাহর দরবারে এর তাৎপর্য জানতে আরয করেন। তৎক্ষণাৎ মাছটির জবান খুলে যায়।

এবং মাছ নিজে আনুপূর্বিক সব ঘটনা বর্ণনা করে। ঐদিন রাসূলুল্লাহ (ছ) এর মজলিসে বহুসংখ্যক ইহুদী উপস্থিত ছিল। তারা মাছের বিবৃতি শ্রবণমাত্র নবী করীম (ছ) এর নিকটে তওবা করে মুসলমান হয়ে যায়। তারপর রাসূলুল্লাহ (ছ) এর আদেশে মাছটিকে নিয়ে নদীতে ছেড়ে দেয়া হয়। ফযীলত ঃ

(১) যারা সর্বদা এ দুরূদ শরীফ আমলে রাখবেন, দোযখের আগুণ কখনও তাদেরকে স্পর্শ করতে পারবে না। তদুপরি মৃত্যুকাল অবধি তাদের স্বাস্থ্য অটুট ও দেহশ্রী লাবণ্যময় হয়ে যাবে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *