ইসলাম

ইসলামে বিয়ের নিয়ম

Share this

বিয়ে সম্পর্কে আদেশ-নিষেধ

মানুষ দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন করে একে অপরের কাছ থেকে যৌন তৃপ্তি লাভ করবে। লাভ করবে মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি। সেই সাথে মানুষের বংশধারা বৃদ্ধি পাবে। স্থিতি ও বৃদ্ধি লাভ করবে মানবতা ।

ইসলাম এ কারণে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে যৌন মিলন করতে নির্দেশ দিয়েছে এবং এ মিলনকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলেও মানুষকে ধারণা দিয়েছে। পক্ষান্তরে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে মানুষকে পশুর ন্যায় স্বেচ্ছাচারী হতে দেয়নি ইসলাম।

কিছু কিছু নারী-পুরুষের পারস্পরিক বিয়ে হারাম করে দেয়া হয়েছে। ইসলাম যে সমস্ত নর-নারীর মধ্য বিয়ের সম্পর্ক অবৈধ বলে ঘোষণা দিয়েছে তার সম্পর্কে তিন দিকে প্রসারিত। যথা-বংশ সম্পর্ক, দুগ্ধপানের সম্পর্ক এবং বৈবাহিক সম্পর্ক। বংশ-সম্পর্কের কারণে মা-বাপের দিক দিয়ে যেসব আত্মীয়তার উদ্ভব হয় তা মোটামুটি সাতটিঃ মা, ঔরসজাত কন্যা, বোন, ফুফু, খালা, ভাইঝি, বোনঝি।

যে কোন পুরুষের পক্ষেই তার এ ধরনের আত্মীয়া মহিলাকে বিয়ে করা চিরদিনের তরে হারাম। আর এ হারামের কারণ হচ্ছে এই বংশ সম্পর্কে। কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতে এ সম্পর্কে স্পষ্ট বলা হয়েছেঃ “বিয়ে করা হারাম করে দেয়া হয়েছে তোমাদের প্রতি তোমাদের মা, তোমাদের কন্যা, তোমাদের বোন, তোমাদের ফুফু, তোমাদের খালা, তোমাদের ভাইয়ের কন্যা এবং বোনের কন্যা।”

মা বলতে এখানে এমন সব মেয়েলোককে বোঝায়, যার সাথে প্রকৃত মা এবং বাবার দিক দিয়ে জন্ম ও রক্তের সম্পর্ক রয়েছে এর এ সম্পর্কের সূচনা হয় দাদি ও নানি থেকে।

অতএব তাদের বিয়ে করাও হারাম। কন্যা বলতে এমন সব মেয়েও বোঝাবে, যাদের সাথে স্বীয় ঔরসজাত কন্যা বা পুত্রের দিক দিয়ে সম্পর্ক রয়েছে। আর বোনের মধ্যে শামিল সেসব মেয়েও, যার সাথে বাপ কিংবা মা অথবা উভয়ের সমন্বয়ে বোনের সম্পর্ক হতে পারে।

ফুফু বলতে এমন মেয়ে লোকও বোঝায়, যে বাবার কি তার বাবার মানে দাদার বোন আর ‘খালা’র মধ্যে এমন সব মেয়েলোকও শামিল, যার সাথে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে মা কিংবা দাদার দিক দিয়ে। বোনঝি বলতে এমন সব মেয়েই বোঝায়, যাদের মায়ের সাথে রক্তের দিক দিয়ে বোনের সম্পর্ক হতে পারে।

এ মোট সাত পর্যায়ের মেয়েলোক ও পুরুষ লোক পরস্পরের জন্যে মুহাররম। এদের পারস্পরিক বিয়ে হারাম। একথা সর্বজনসমর্থিত কোন মতভেদ নেই এতে। কেননা কুরআন হুররিমাত আলায়কুম’ বলে এদেরকেই স্পষ্ট হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। দুধ পানের সম্পর্কেও কিছু সংখ্যক মেয়ে-পুরুষের পারস্পরিক বিয়ে হারাম ।

ছেলে বা মেয়ে দুগ্ধপোষ্য অবস্থায় যদি অপর কোন মহিলার দুধ পান করে, তবে সে মহিলা হবে তার দুধ-মা, তার স্বামী হবে এর দুধ-বাপ। এ দুধ-মা ও বাপের সাথে বিয়ে সম্পর্ক স্থাপন দুধ পানকারী পুরুষ বা নারীর জন্য হারাম, যেমন হারাম প্রকৃত মা বোনের সাথে বিয়ে । অনুরূপভাবে দুধ-বোনও হারাম ।

এ সম্পর্কে কুরআন মজীদে দুদ-মা ও দুধ বোন উভয় সম্পর্কে স্পষ্ট বলা হয়েছেঃ “এবং তোমাদের স্তনদায়িনী মা-দের এবং তোমাদের দুধ-বোনদেরকে বিয়ে করা তোমাদের জন্যে হারাম করা হয়েছে।” আল্লামা ইবনে রুশদ আল কুরতুবী এ পর্যায়ে লিখেছেনঃ “মোটামুটিভাবে বংশ সম্পর্কের কারণে যাকে বিয়ে করা হারাম, দুধ পানের কারণেও তাকে বিয়ে করা হারাম হওয়া সম্পর্কে সব

ফিকাহবিদই সম্পূর্ণ একমত অর্থাৎ স্তনদায়িনী আপন মায়ের সমান পর্যায়ে গণ্য হবে। অতএব বংশের দিক দিয়ে ছেলের প্রতি হারাম যাকে যাকে বিয়ে করা, দুগ্ধদায়িনীর পক্ষেও সে সে হারাম।”

দুধ বোন সম্পর্কে আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ “সৎ-বোন সে, যাকে তোমার মা তোমার বাবার কাছে থেকে পাওয়া দুধ সেবন করিয়েছে, তা তোমার সাথে এক সঙ্গে সেবন করুক, কি তোমার পূর্বে বা তোমার পরে। ছেলে হোক আর মেয়ে হোক।”

হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন। হযরত রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ “দুধ পানে সে সে হারাম হয়ে যায়, যে যে হারাম জন্মগত সম্পর্কের কারণ।” এজন্যে হযরত আয়েশা (রা) সব সময় বলতেনঃ “তোমরা দুধ পানের কারণে তাকে তাকে হারাম মনে করবে, কথা হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছে। যাকে যাকে হারাম মনে কর বংশের কারণে।”

নবী করীম (স) -এর আর একটি তিনি বলেছেনঃ “রেহমী সম্পর্কের কারণে যে যে হারাম হয়, দুধ পানের দরুনও সে সে হারাম হয়।” বৈবাহিক সম্পর্কের দিক দিয়েও কোন কোন আত্মীয়ের সাথে বিয়ে সম্পর্ক স্থাপন হারাম হয়ে যায়। এ হারাম দু’প্রকারের ।

এক, স্থায়ী॥ যেমন স্ত্রীর মা, পুত্রের স্ত্রী, যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে এমন স্ত্রীর কন্যা এবং পিতার স্ত্রী। পিতার স্ত্রী সম্পর্কে কুরআন মজীদে স্পষ্ট নিষেধবাণী উচ্চারিত হয়েছে। বলা হয়েছেঃ “তোমাদের পিতারা যাকে যাকে বিয়ে করেছে, তাকে তাকে তোমরা বিয়ে কোরো না।”

এর কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে স্বয়ং কুরআনেই বলা হয়েছেঃ “পিতার বিয়ে করা স্ত্রীকে বিয়ে করা অত্যন্ত লজ্জাকর ও জঘন্য কাজ, গুনাহের ব্যাপার এবং বিয়ের খুবই খারাপ পথ।”

আল্লামা শাওকানী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ (“পিতার বিয়ে করা স্ত্রীকে পুত্রের বিয়ে করা সম্পর্কে) নিষেধ বাণীর যে তিনটি কারণ উদ্ধৃত হয়েছে, তা প্রমাণ করে যে, এ কাজ অত্যন্ত সাংঘাতিক রকমের হারাম ও ঘৃণিত কাজ।”

আর পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করার ব্যাপারে কুরআনের নিষেধবাণী হচ্ছেঃ “তোমাদের স্ত্রীদের মা’দেরও হারাম করা হয়েছে। স্ত্রীদের মা হারাম হওয়ার আয়াত হচ্ছেঃ “তোমাদের স্ত্রীদের মা’দেরও হারাম করা হয়েছে।”

আর স্ত্রী গর্ভজাত মেয়েকে বিয়ে করা হারাম হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতের ভিত্তিতেঃ “এবং তোমাদের সেসব স্ত্রীদের যাদের সাথে তোমাদের যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে-গর্ভজাত মেয়েরাও হারাম।” যৌন সম্পর্ক স্থাপিত না হলে তাদের কন্যাকে বিয়ে করা হারাম নয়।

“যদি বিয়ে করা স্ত্রীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত না করে থাকে, তবে তার কন্যাকে বিয়ে করায় কোন দোষ নেই।” এ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে রুশদ আল কুরতুবী লিখেছেনঃ “এ চারজনের মধ্যে দুজন হারাম হয়ে যায় বিয়ের আকদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।

তারা হচ্ছে পিতার স্ত্রী পুত্রের জন্যে ও পুত্রের স্ত্রী পিতার জন্যে, আর একজন , হারাম হয় স্ত্রীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হলে পরে সে হচ্ছে স্ত্রীর অপর এক স্বামীর নিকট থেকে নিয়ে আসা কন্যা। আর দ্বিতীয় অস্থায়ী ও সাময়িক ।

যেমন স্ত্রীন বোর, স্ত্রীর ফুফু, খালা, ভাইঝি-বোনঝি ইত্যাদি । স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় স্ত্রীর এসব নিকটাত্মীয়কে বিয়ে করা ও একত্রে এক স্থায়ী স্ত্রীতে বরণ করা ইসলামে হারাম। এ কথার ভিত্তি হচ্ছে নিম্নোক্ত আয়াতাংশঃ “এবং দু’জন সহোদর বোনকে একত্রে স্ত্রীরূপে বরণ করা তোমাদের জন্যে নিষিদ্ধ।”

এ আয়াতের ভিত্তিতে ফিকাহবিদগণ মূলনীতি নির্ধারণ করেছেনঃ “যে দু’জন স্ত্রীলোকের পারস্পরিক আত্মীয়তার কারণে বিয়ে হারাম,তাদের দুজনকে একজন স্বামীর স্ত্রীত্বে একত্রে বরণ করা হারাম।” এভাবে যেসব মেয়েলোককে বিয়ে করা একজন পুরুষের পক্ষে হারাম তাদের সংখ্যা দাঁড়ালো (ক) বংশের ও রক্তের সম্পর্কের কারণে সাতজন ।

আর তারা হচ্ছে, মা, কন্যা, বোন, ফুফু, খালা, ভাইঝি ও বোনঝি । (খ) বৈবাহিক ও দুগ্ধপানের কারণে মোট সাতজন। তারা হচ্ছেঃ দুধ-মা, দুধ-বোন, স্ত্রীর মা, স্ত্রীর পূর্বপক্ষের কন্যা ও দুবোনকে একত্রে বিয়ে করা।

এতদ্ব্যতীত পিতার স্ত্রী এবং ফুফু-ভাইঝিকে একত্রে বিয়ে করা। ইমাম তাহাভী বলেছেনঃ “এ কয়জনকে বিয়ে করা যে কোন পুরুষের পক্ষে স্থায়ী ও সর্ববাদীসম্মতভাবে হারাম! এ বিয়ে কারো কোন মতভেদ নেই।

এরপর আল্লাহ তা’আলা সেসব স্ত্রীলোককে হারাম করে দিয়েছেন, যারা বিবাহিত॥ যাদের স্বামী জীবিত ও বর্তমান। বলেছেনঃ “এবং স্বামীওয়ালী সুরক্ষিতা মহিলাদের বিয়ে করাও হারাম।” আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ “এখানে ‘মুহসানাত’ মানে সেসব মেয়েলোক, যাদের স্বামী বর্তমান॥ যারা বিবাহিত।”

যেসব মেয়েলোককে বিয়ে করা হারাম, তাদের বর্ণনা দেয়ার পর আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করছেনঃ “এ হারাম-মুহাররম-স্ত্রীলোকদের ছাড়া অন্যান্য সব মেয়েলোকই বিয়ে করার জন্যে তোমাদের পক্ষে হালাল করে দেয়া হয়েছে এ উদ্দেশ্যে যে, তোমরা তাদেরকে তোমাদের মাল-মোহরানা দিয়ে সুরক্ষিত বিবাহিত জীবন যাপনের লক্ষ্যে গ্রহণ করবে, উচ্ছৃঙ্খল যৌন লালসা পূরণের কাজে নয় ।

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ“ উপরে উল্লিখিত মহিলাদের ছাড়া অন্যান্য সব মেয়েলোক বিয়ে করা জায়েয। সম্পূর্ণ হালাল, তা এ আয়াতাংশ স্পষ্ট প্রমাণ করছে।”

মানুষ দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন করে মানব বংশ বৃদ্ধি করবে এবং যৌন তৃপ্তি লাভ করবে ঠিক তেমনি উল্লেখিত বিধিনিষেধও অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করবে। এটাই মুসলিম পরিবারের জন্যে ইসলামের বিধান। এ বিধান লংঘন করে মানুষ যদি যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে তাহলে তা হবে সম্পূর্ণ অবৈধ। এ ধরনের মানুষ আর পশুর জীবনে কোন পার্থক্য থাকবে না।

ফলে সমাজ জীবনে নেমে আসবে অপবিত্রতা ও কলুষতা । কিন্তু ইসলামের লক্ষ্যই হলো একটি পূত ও পবিত্র পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা। এ কারণেই ইসলাম অত্যন্ত যৌক্তিক বিধি-বিধান মানব জাতির প্রতি আরোপ করেছে।

মানুষ আর পশুর জীবনে কোন পার্থক্য থাকবে না। ফলে সমাজ জীবনে নেমে আসবে অপবিত্রতা ও কলুষতা। কিন্তু ইসলামের লক্ষ্যই হলো একটি পূত যৌক্তিক বিধিবিধান মানব জাতির প্রতি আরোপ করেছে। পবিত্র পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা।

আরো পড়ুন:- স্বামীর হক বা অধিকার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *