স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা
Share this
দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্য
স্বামীর যেমন অধিকার রয়েছে স্ত্রীর প্রতি অনুরূপ অধিকার রয়েছে স্বামীর উপর স্ত্রীর। স্বামী সংসারের প্রধান। সে কারণে সংসারের আর্থিক ব্যাপারে তার সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। স্ত্রী যাবতীয় প্রয়োজন সে পূরণ করবে। স্বামী যেমন নিজের সুখের প্রতি দৃষ্টি রাখবে তেমনিই দৃষ্টি রাখবে স্ত্রীর সুখের প্রতি ।
মহানবী (স) বলেন, “ নিশ্চয়ই তোমার স্ত্রীর তোমার উপর একটি অধিকার রয়েছে।” কেবল স্ত্রীর অধিকার স্বামীর উপর, সে কথা নয়, স্বামীরও অধিকার রয়েছে স্ত্রীর উপর। আল্লামা বদরুদ্দীন এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ “ স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেকেরই অধিকার রয়েছে প্রত্যেকের উপর।” স্বামীর উপর স্ত্রীর যা কিছু অধিকার, তার মধ্যে একটি হচ্ছে তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন ।
আর সাধারণভাবে তার প্রাপ্য হচ্ছেঃ “ তাকে খাবার দেবে যখন যেমন তুমি নিজে খাবে এবং তার পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করে দেবে, যেমন মানের পোশাক তুমি নিজে গ্রহণ করবে।” এ হাদীসের তাৎপর্য মাওলানা খলীলুর রহমান লিখেছেনঃ “স্ত্রীর খোরাক ও পোশাক গোড়া করে দেয়া স্বামীর কর্তব্য,যখন সে নিজের জন্যে এগুলোর ব্যবস্থা করতে সমর্থ হবে।”
আল্লামা আল-খাত্তাবী লিখেছেনঃ “এ হাদীস স্ত্রীর খোরাক-পোশাকের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা স্বামীর উপর ওয়াজিব করে দিচ্ছে। এ ব্যাপারে কোন সীমা নির্দিষ্ট নেই, প্রচলন মতই তা করতে হবে, করতে হবে স্বামীর সামর্থানুযায়ী। আর রাসূলে করীম (স) যখন একে ‘অধিকার’ বলেন তখন তা স্বামীর অবশ্য আদায় করতে হবে৷ সে উপস্থিত থাক, কি অনুপস্থিত । সময়মত তা পাওয়া না গেলে তা স্বামীর উপর অবশ্য দেয় ঋণ হবে৷ যেমন অন্যান্য হক অধিকারের ব্যাপারে হয়ে থাকে।”
স্বামী-স্ত্রীর সন্তুষ্টির জন্যে নিজেকে সজ্জিত করবে
পোষাক মানুষকে একটা ভিন্ন ধরনের সৌন্দর্য দান করে । গোঁফ-দাড়ি, হাত ও পায়ে নখ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে স্ত্রীর নিকট যাওয়াও স্ত্রীর অধিকার স্বামীর উপর এবং তা স্বামীর কর্তব্য স্ত্রীর প্রতি। স্বামী যদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে স্ত্রীর নিকট উপস্থিত হয়, তবে তাতে স্ত্রীর মনে আনন্দের ঢেউ খেলে যাওয়া স্বাভাবিক ।
কেননা তাতে প্রমাণ হয় যে, স্বামী স্ত্রীর মন জয় করার জন্যে বিশেষ যত্ন নিয়েছে এবং পূর্ণ প্রস্তুতি সহকারেই সে স্ত্রীর নিকট হাজির হয়েছে। অপরিচ্ছন্ন, মলিন দেহ ও পোশাক নিয়ে স্ত্রীর নিকট যাওয়া স্বামীর একেবারেই অনুচিত।
স্ত্রীরও কর্তব্য স্বামীর ইচ্ছানুযায়ী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা ও সে অবস্থায়ই স্বামীর নিকট যাওয়া। এজন্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সাবান ও অন্যান্য জরুরী প্রসাধন দ্রব্য সংগ্রহ করে দেয়া স্বামীর কর্তব্য। হযরত ইবনে আব্বাস এ পর্যায়ে একটি নীতি হিসেবে বলেছেনঃ “আমি স্ত্রীর জন্যে সাজসজ্জা করা খুবই পছন্দ করি, যেমন পছন্দ করি স্ত্রী আমার জন্যে সাজসজ্জা করুক।”
স্ত্রী অসুস্থ হলে স্বামীর দায়িত্ব
নারী মায়ের জাত। তারা সন্তান প্রসব করে পৃথিবীতে মানব বংশ বৃদ্ধি করে । সন্তান গর্ভে ধারণ করা ও নির্দিষ্ট সময়ে প্রসব করা,সন্তানকে লালন-পালন করা যে কত কঠিন কাজ, তা অনুভব করাও কল্পনাতিত। একজন পুরুষ কখনো কখনো নারীর সে ব্যথা-বেদনা কখনো উপলব্ধি করতে পারবে না ।
এ সমস্ত কারণে স্ত্রী ঘন ঘন অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। সংসারের অন্যান্য কাজকর্ম করতে সে অপারগ হয়ে পড়তে পারে। তখন স্বামীর একান্ত কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় স্ত্রীর কাজে সহযোগিতা করা। অসুস্থ অবস্থায় স্ত্রীকে যৌন মিলনে বাধ্য না করা ।
স্ত্রীর বিপদে-আপদে, রোগে-শোকে তার প্রতি অকৃত্রিম সহানুভূতি প্রদর্শন করা স্বামীর কর্তব্য। স্ত্রী রোগাক্রান্ত হলে তার চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা করা স্বামীরই দায়িত্ব। বস্তুত স্ত্রী সবচেয়ে বেশি দুঃখ পায় তখন, যখন তার বিপদে-শোকে তার স্বামীকে সহানুভূতিপূর্ণ ও দুঃখ ভারাক্রান্ত দেখতে না পায় অথবা স্ত্রীর যখন কোন বিপদ হয়,
শোক হয় কিংবা রোগ হয়, তখন স্বামীর মন যদি তার জন্যে দ্রবীভূত না হয়, বরং তখন স্বামীর মন মৌমাছির মত অন্য ফুলের সন্ধানে উড়ে বেড়ায়, তখন বাস্তবিকই স্ত্রীর দুঃখ ও মনোকষ্টের কোন অবধি থাকে না। এজন্যে নবী করীম (স) স্ত্রীর প্রতি দয়াবান ও সহানুভূতিপূর্ণ হবার নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি এর সাধারণ নিয়ম হিসেবে বলেছেনঃ “ যে লোক নিজে অপরের জন্যে দয়াপূর্ণ হয় না, সে কখনো অপরের দয়া-সহানুভূতি লাভ করতে পারে না।”
কোন্ স্বামী আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত
স্বামী-স্ত্রীর যৌন জীবন একান্ত গোপন জীবন। এ সম্পর্কে স্বামী ও স্ত্রীই শুধু অবগত থাকবে৷ অন্য কেউ নয় । স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-ভালবাসার আদান-প্রদান হয়, হয় পারস্পরিক মনের গোপন কথা বলাবলি । একজন তো অকৃত্রিম আস্থা ও বিশ্বাস নিয়েই অপরজনকে তা বলেছে, এখন যদি কেউ অপর কারো কথা কিংবা যৌন-মিলন সংক্রান্ত কোন রহস্য অন্য লোকদের কাছে বলে দেয়, তাহলে একদিকে যেমন বিশ্বাস ভঙ্গ হল অপরদিকে লজ্জার কারণ ঘটল ।
এই কারণে ইসলামে এ কাজকে সম্পূর্ণ নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। বস্তুত একজন যদি তাদের স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক প্রেম-ভালবাসার কথা বাইরের কোন লোক-নারী বা পুরুষকে বলে দেয়, তাহলে শ্রোতার মনে সেই স্ত্রী বা পুরুষের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
আর যদি কেউ যৌন সঙ্গম কার্যের বিবরণ অন্য লোকের সামনে প্রকাশ করে,তাহলে তার গোপনীয়তা বিলুপ্ত হয়, গুপ্ত ব্যাপারাদি উন্মুক্ত ও দৃশ্যমান হয়ে উঠে । কোন নেকবত স্ত্রীর দ্বারাও যেমন এ কাজ হতে পারে না, তেমনি কোন আল্লাহ ভীরু ব্যক্তির দ্বারাও এ কাজ সম্ভব নয়।
বিশেষভাবে মেয়েরাই এ ব্যাপারে অগ্রসর হয়ে থাকে বলে কুরআনে তাদের গুণাবলীর বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ তারা অতিশয় বিনীতা, অনুগতা অদৃশ্য কাজের হেফাযতকারিনী আল্লাহর হেফাযতের সাহায্যে।” স্বামীর উপর স্ত্রীর অধিকার হচ্ছে এই যে, সে স্ত্রীর গোপন কথা অপরের নিকট প্রকাশ করে দেবে না।
নবী করীম (স) তীব্র ভাষায় নিষেধ করেছেন এ ধরনের কোন কথা প্রকাশ করতে। বলেছেনঃ “ যে স্বামী নিজ স্ত্রীর সাথে মিলিত হয় ও স্ত্রী মিলিত হয় তার স্বামীর সাথে, অতঃপর সে তার স্ত্রীর গোপন কথা প্রকাশ করে দেয়।প্রচার করে, সেই স্বামী আল্লাহর নিকট মর্যাদার দিক দিয়ে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি।”
ইমাম নব্বীর মতে এ কাজ হচ্ছে হারাম। তিনি উক্ত হাদীসের ভিত্তিতে বলেছেনঃ “ স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের মধ্যে যৌন-সম্ভোগ সম্পর্কিত গোপন বিষয় ও ঘটনা প্রকাশ করা এ হাদীসে সম্পূর্ণরূপে হারাম করে দেয়া হয়েছে।” একদিন রাসূলে করীম (স) নামাযের পরে উপস্থিত সকল সাহাবীকে বসে থাকতে বললেন এবং প্রথমে পুরুষদের লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলেনঃ “ তোমাদের মধ্যে এমন পুরুষ কেউ আছে নাকি, যে তার স্ত্রীর নিকট আসে, ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়, তারপর বের হয়ে এসে লোকদের সাথে কথা বলে ও বলে দেয়ঃ আমি আমার স্ত্রীর সাথে এই করেছি, এই করেছি?”
হাদীস বর্ণনাকারী বলেছেন- এ প্রশ্ন শুনে সব সাহাবীই চপ থাকলেন । তারপরে মেয়েদের প্রতি লক্ষ্য করে তাদের নিকট প্রশ্ন করলেনঃ “ তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে নাকি, যে স্বামী-স্ত্রীর মিলন রহস্যের কথা প্রকাশ করে ও অন্যদের বলে দেয়?
তখন এক যুবতী মেয়ে বলে উঠলঃ “ আল্লাহর শপথ, এই পুরুষরা যেমন সে কথা বলে দেবে, তেমনি এই মেয়েরাও তা প্রকাশ করে।” তখন নবী করীম (স) বললেনঃ “ তোমরা কি জানো, এরূপ যে করে তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে, সে যেন একটি শয়তান,
সে তার সঙ্গী শয়তানের সাথে রাজপথের মাঝখানে সাক্ষাত করল, অমনি সেখানে ধরেই তার দ্বারা নিজের প্রয়োজন পূর্ণ করে নিল । আর চারদিকে লোকজন তাদের তাকিয়ে দেখতে থাকলো এ পর্যায়ে দুটো হাদীসের ভিত্তিতে ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ “ এ দুটো হাদীসই প্রমাণ করছে যে, স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গমকার্য প্রসঙ্গে যত কিছু এবং যা কিছু ঘটে থাকে, তার কোন কিছু প্রকাশ করা অন্যদের কাছে বলে দেয়া সম্পূর্ণ হারাম।”
সংসার জীবনের ব্যয়ভার ও স্বামীর কর্তব্য
দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীকে করা হয়েছে সংসারের কর্ত্রী। সংসারে যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করবে স্বামী । স্ত্রীর যা প্রয়োজন তাও বহন করবে স্বামী। স্ত্রী স্বয়ং যদি প্রভূত অর্থবিত্তের মালিক হয় তবুও স্বামীকেই বহন করতে হবে স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব ।
স্ত্রী যদি নিজে অর্থোপার্জন করে তবুও স্বামীর দায়িত্ব স্ত্রীর খরচ দেয়া। এক্ষেত্রে স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় স্বামীর ভার লাঘবের জন্যে যদি স্বামীর নিকট হতে খরচ গ্রহণ করে তা হলে সে কথা ভিন্ন । স্ত্রীকে প্রতিপালনের দায়িত্ব স্বামীর, এ ব্যাপারে কোরআন-হাদীস ও মনিষীদের মতামত উল্লেখ করে আল্লামা আব্দুর রহিম (রহ) তার পরিবার ও পারিবারিক জীবন গ্রন্থে যে আলোচনা করেছেন তা উল্লেখ করা গেল, এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ
যে লোককে অর্থ-সম্পদে সাচ্ছন্দ্য দান করা হয়েছে, তার কর্তব্য সেই হিসেবেই তার স্ত্রী-পরিজনের জন্যে ব্যয় করা। আর যার আয়-উৎপাদন স্বল্প পরিসর ও পরিমিত, তার সেভাবেই আল্লাহর দান থেকে খরচ করা কর্তব্য। আল্লাহ প্রত্যেকের উপর তার সামর্থ্য অনুসারেই দায়িত্ব অর্পণ করে থাকে।” এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ “ এ আয়াতে আদেশ করা হয়েছে সচ্ছল অবস্থার লোকদের যে, তারা দুগ্ধদায়িনী স্ত্রীদের জন্যে তাদের স্বাচ্ছন্দ্য অনুপাতে বহন করবে।”
আর যাদের রিযিক নিম্নতম প্রয়োজন মত কিংবা সংকীর্ণ, সচ্ছল নয়, তারা আল্লাহর দেয়া রিযিক অনুযায়ীই খরচ করবে। তার বেশি করার কোন দায়িত্ব তাদের নেই।”
স্ত্রীদের জন্যে খরচ বহনের কোন পরিমাণ শরীয়াতে নির্দিষ্ট আছে কি না – এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মত রয়েছে। ইমাম মালিক ও ইমাম আহমাদ বলেছেনঃ “স্ত্রীর ব্যয়ভারের কোন পরিমাণ শরীয়তে নির্দিষ্ট নয়, বরং তা বিচার-বিবেচনার উপরই নির্ভর করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের অবস্থা বিবেচনীয়। সচ্ছল অবস্থার স্ত্রীর জন্যে সচ্ছল অবস্থার স্বামী সচ্ছল লোকদের উপযোগী ব্যয় বহন করবে। অনুরূপভাবে অভাবগ্রস্ত স্ত্রীর জন্যে অভাবগ্রস্ত স্বামী ভরণ-পোষণের নিম্নতম দায়িত্ব পালন করবে। উপরোক্ত আয়াতের শেষাংশ প্রমাণ করছে যে, সামর্থ্যের বেশি কিছু করা স্বামীর পক্ষে ওয়াজিব নয়। ইমাম আবূ হানীফারও এই মত ।
আল্লামা ইবনুল হুম্নান লিখেছেনঃ “ স্বামী যদি গরীব হয়, আর স্ত্রী যদি হয় স্বচ্ছল অবস্থার, তাহলে স্বামী গরীব লোক উপযোগী ভরণ-পোষণ দেয়ার জন্যে দায়িত্বশীল। কেননা, স্ত্রী নিজে সচ্ছল অবস্থার হলেও সে যখন গরীব স্বামী গ্রহণ করতে রাজী হয়েছে, তখন সে প্রকান্তরে গরীবলোক উপযোগী খোরপোষ গ্রহণেও রাযী বলতে হবে।
পক্ষান্তরে স্বামী যদি সচ্ছল অবস্থার হয়, আর যদি স্ত্রী হয় গরীব অবস্থার, তাহলে সে সচ্ছল লোক উপযোগী ব্যয়ভার লাভ করতে পারবে । স্বামীর অবস্থা অনুযায়ী স্ত্রীকে খোরপোশ দেয়ার কথা কুরআন থেকে প্রমাণিত ।
হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেনঃ “ আবূ সুফিয়ানের স্ত্রী -উৎবা-কন্যা-রাসূলে করীম (স) এর সমীপে উপস্থিত হয়ে নিবেদন করলেনঃ “ হে আল্লাহর রাসূল, আমার স্বামী আবূ সুফিয়ান একজন কৃপণ ব্যক্তি, সে আমার ও আমার সন্তানদের প্রয়োজনীয় পরিমাণ ভরণপোষণ দেয় না, তবে আমি তাকে না জানিয়ে প্রয়োজন মত গ্রহণ করে থাকি। এ কাজ জায়েয কিনা?”
তখন নবী করীম (স) তাকে বললেনঃ “সাধারণ প্রচলন অনুযায়ী তোমার ও তোমার সন্তানাদির প্রয়োজন পরিমাণ ভরণ-পোষণ তুমি গ্রহণ করতে পার।” এ হাদিস থেকে জানা যায় যে আবু সুফিয়ান স্বচ্ছল অবস্থাসম্পন্ন ছিল, রাসূলে করীম (স) জানতেন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও সে কেবলমাত্র কৃপণতার কারণে নিজ স্ত্রী ও পুত্র-কন্যার প্রয়োজন পরিমাণ ভরণপোষণ দিত না। সেই কারণে রাসূলে করীম (স) তার স্ত্রীকে প্রয়োজন পরিমাণ গ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছিলেন।
ইমাম শাফিয়ীর মতে এই পরিমাণ শরীয়াত কর্তৃক নির্দিষ্ট বলে এ ব্যাপারে বিচার-বিবেচনার কোন অবকাশ নেই। আর এ ব্যাপারে স্বামীর অবস্থানুযায়ীই ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতে হবে। স্ত্রীর যদি খাদেম-চাকরের প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে স্বামীর সামর্থ্য থাকলে খাদেম চাকর যোগাড় করে দেয়া স্বামীর কর্তব্য।
এ ব্যাপারে ফিকাহবিদগণ সম্পূর্ণ একমত। ইমাম মুহাম্মদ বলেছেনঃ একাধিক খাদেম-চাকরের খরচ বহন করা অসচ্ছল অবস্থার স্বামীর জন্যেও ওয়াজিব হবে।” একজন খাদেম-চাকরের প্রয়োজন হলে তাও সংগ্রহ করা ও খরচ বহন করা স্বামীর কর্তব্য কি না এ সম্পর্কে ফিকাহবিদগণ একমত নন।
ইমাম মালিকের মতে দুই বা তিন জন খাদেমের প্রয়োজন হলে তার ব্যবস্থা করা স্বামীর কর্তব্য । আর ইমাম আবূ ইউসুফ বলেছেনঃ ‘ এমতাবস্থায় স্বামীর কর্তব্য
হবে শুধু একজন খাদেমের ব্যবস্থা করা ও খরচ বহন করা। তাদের কর্তব্য ঘরের ভিতরকার জরুরী কাজকর্ম করার জন্যে ।
আর অপর জন হবে ঘরের বাইরের জরুরী কাজ সম্পন্ন করার জন্যে। গরীব ও অসচ্ছল স্বামীদের সান্ত্বনা দানের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’আলা উক্ত আয়াতের পরই বলেছেনঃ “আল্লাহ অসচ্ছলতা ও দারিদ্র্যের পক্ষে অবশ্যই সচ্ছলতা প্রাচুর্য সৃষ্টি করে দেবেন।” এ পর্যায়ে কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতটিও পাঠ আবশ্যক ।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ “সন্তানের পিতার কর্তব্য হচ্ছে প্রসূতির খাবার ও পরার প্রচলিত মানে ব্যবস্থা করা । কোন ব্যক্তির উপরই তার সামর্থ্যের অধিক বোঝা চাপান যেতে পারে না। এ আয়াতের ভিত্তিতে ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ “ সন্তান ও স্ত্রীর ব্যয়ভাব, খোরাক ও পোশাক সংগ্রহ ও ব্যবস্থা করা সন্তানের পিতার পক্ষে ওয়াজিব। আর তা করতে হবে সাধারণ প্রচলন অনুযায়ী যা লোকেরা সাধারণত করে থাকে। এ ব্যাপারে কোন পিতাকেই তার শক্তিসামর্থ্যের বাইরে তার পক্ষে কঠিন ও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে॥এমন মান বা পরিমাণ তার উপর চাপান যাবে না।”
এ আয়াত থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, সন্তান গর্ভে ধারণ, সন্তান প্রসব ও লালনপালন করা স্ত্রীর কাজ; আর তার ও তার সন্তানের ভরণপোষণ ও যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব স্বামীর। এর ফলে স্ত্রীরা খোরপোশের যাবতীয় চিন্তাভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে গেল । এর প্রভাব তাদের মনে ও জীবনে সুদূর প্রসারী হবে।
রাসূলে করীম (স) স্বামীদের লক্ষ্য করে তাই ইরশাদ করেছেনঃ “স্ত্রীদের খাবার ও পরার ব্যবস্থা করার ব্যাপারে তোমরা অবশ্যই তাদের প্রতি ভাল ব্যবহার করবে।” অর্থাৎ কেবলমাত্র মোটা ভাত ও মোটা কাপড়ের ব্যবস্থা করেই ক্ষান্ত হলে চলবে না।
এ ব্যাপারে তাদের প্রতি কঠোরতা অবলম্বনের বদলে সহানুভূতিমূলক নীতি গ্রহণ করবে। আলোচনার সারকথা হচ্ছে এই যে, স্বামী-স্ত্রীতে অতি স্বাভাবিকভাবেই কর্মবন্টন করে দেয়া হয়েছে।
যে যৌন মিলনের সুখ ও মাধুর্য স্বামী-স্ত্রী উভয়েই সমানভাবে ভোগ করে, তার সুদূর প্রসারী পরিণতি কেবল স্ত্রীকেই ভোগ করতে হয় প্রকৃতির এক অমোঘ নিয়ম অনুযায়ী। পুরুষকে তার কোন ঝুঁকিই গ্রহণ করতে হয় না ৷
এ হচ্ছে এক স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক ব্যবস্থা । কাজেই স্ত্রী প্রকৃতির এই দাবী পূরণে সতত প্রস্তুত থাকবে, আর স্বামী তার যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের জন্যে দায়ী হবে। মূল ব্যাপারে সমান অংশীদারিত্বের একটা অতি স্বাভাবিক দাবী।
উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস থেকে একথাও প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রীর চলতি নিয়মে কেবল খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করে দেওয়াই দাম্পত্য জীবনের মাধুর্য সৃষ্টির পক্ষে যথেষ্ট নয়, সেই সঙ্গে স্বামীর তওফীক অনুযায়ী তারও বেশি অতিরিক্ত হাত খরচও স্ত্রীর হাতে তুলে দেয়া স্বামীর কর্তব্য; যেন স্ত্রী নিজ ইচ্ছা, বাসনা কামনা ও রুচি অনুযায়ী সময়ে অসময়ে খরচ করতে পারে।
এতে করে স্ত্রীর মনে স্বামীর প্রতি ভালবাসা, আস্থা ও নির্ভরশীলতা অত্যন্ত দৃঢ় ও গভীর হবে।
স্ত্রীর মন মেজাজ স্বামীকে বুঝতে হবে
নারী সৃষ্টিগতভাবে পুরুষের তুলনায় দুর্বল। তারপরেও পৃথিবীতে সব চেয়ে কঠিন দায়িত্ব॥সন্তান ধারণ ও প্রসব, লালন-পালনের দায়িত্ব তাকেই পালন করতে হয়। প্রতিমাসে ঋতুস্রাব হয়। ইত্যাদি কারণে নারীর মন-মানসিকতা তিক্ত বিরক্ত হয়ে থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয় ।
সুতরাং দাম্পত্য জীবন স্থায়ী, অটুট রাখতে হলে, দাম্পত্য জীবনে শান্তি বজায় রাখতে হলে স্ত্রীর মনমেজাজ স্বামীকে বুঝতে হবে। স্ত্রীর মন-মানসিকতা বুঝে তার সাথে কথাবার্তা বলা উচিত । কোন কারণে স্ত্রী যদি উত্তেজিত হয়ে উচ্চ কণ্ঠে স্বামীকে দুটো কথা শোনায়
এ ক্ষেত্রে স্বামীকে নীরবতা অবলম্বন করে অন্য কোন আনন্দঘন মুহূর্তে স্ত্রীর ভুল ধরিয়ে দেয়া উচিত। উভয়েই যদি উত্তেজিত হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি নেমে আসবে। পারিবারিক জীবনে শান্তি স্থিতি বজায় রাখতে হলে স্বামীকে অবিচল নিষ্ঠা ও অপরিসীম ধৈর্য ধরতে হবে। এ কথা মনে রাখতে হবে, ধৈর্যশীলদের সাহায্যকারী স্বয়ং আল্লাহ ।
স্বামী পৃথক একটি ঘর দেবে স্ত্রীকে
স্বামীর অবশ্যই কর্তব্য যে স্ত্রীর জন্যে একটা ঘর দেবে। সে ঘরের মালিক হবে একান্তভাবেই স্ত্রী। স্বামীর বাড়িতে এসে একজন নারী যদি তার নিজস্ব একটা ঘর এবং তার ব্যবহারের জিনিসপত্র এবং তা সংরক্ষণ করতে না পারে, তাহলে স্বামীর প্রতি তার মন-মানসিকতা বিষিয়ে উঠতে পারে। ইসলাম নারীর এই অধিকারের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে স্বামীকে নির্দেশ দিয়েছে স্ত্রীকে পৃথক ঘর দেয়ার জন্যে।
তার সাজসজ্জা ও ব্যবহারের সামগ্রী দেয়ার জন্যে। সে সমস্ত সামগ্রী স্ত্রী যেন হেফাজতে রাখতে পারে এজন্যে একটা ব্যবস্থারও তার প্রয়োজন। এসব কিছুর উপর অধিকার একমাত্র স্ত্রীর । পক্ষান্তরে স্ত্রীর নিজের জিনিসের উপরে সে যদি স্বামীর আত্মীয়দেরকে অধিকার দেয় স্বইচ্ছায়। তবে ভিন্ন কথা ।
কিন্তু স্ত্রীর জিনিস স্বামী তার মতের বিরুদ্ধে অন্য কাউকে ব্যবহার করতে দেবে এ অধিকার স্বামীর নেই। যদিও সে সব জিনিস স্ত্রীকে স্বামীই দান করেছে।
স্বামীর সমস্যায় স্ত্রীর পরামর্শ
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, বর্তমানে মুসলিম পরিবারে নারী সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়, নারী অবলা মেয়ে মানুষের কি কোন বুদ্ধি আছে! অত্যন্ত অশালীন ভাষায় নারী সম্পর্কে এ ধরনের অবাঞ্চিত মন্তব্য শোনা যায়।
কিন্তু নারীও যে প্রয়োজনের খাতিরে পুরুষের বিচার বিবেচনাকে ম্লান করে দিয়েছে৷ইতিহাসে এর বহু প্রমাণ রয়েছে, এ কথা পুরুষ ভুলে যায়। সুতরাং দাম্পত্য জীবনে নারী হলো পুরুষের দুঃখ-সুখের চির সাথী, জীবনসঙ্গিনী ।
স্বামী পরামর্শ চাইবে স্ত্রীর কাছে
আল্লাহর ইচ্ছা স্ত্রীর পরামর্শে নিমিষে স্বামীর সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে। রাসূলে করীম (স) এর জীবনে এ পর্যায়ের বহু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। সর্বপ্রথম অহী লাভ করার পর তাঁর হৃদয়ে যে ভীতি ও আতংকের সৃষ্টি হয়েছিল, তার অপনোদনের জন্য তিনি ঘরে গিয়ে স্বীয় প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রা) এর নিকট সব অবস্থার বিবরণ দান করেন।
বলেছিলেনঃ “আমি এ সম্পর্কে নিজের সম্পর্কে ভীত হয়ে পড়েছি” এ কথা শুনে জীবনসঙ্গিনী হযরত খাদীজা (রা) তাঁকে বলেছিলেন : “ আল্লাহ আপনাকে কখনোই এবং কোনদিনই লজ্জিত করবেন না
কেননা আপনি তো ছেলায়ে (আত্মীয়তার সম্পর্ক)-র রেমী রক্ষা করেন, অপরের বোঝা বহন করে থাকেন, কপদকহীন গরীবদের জন্যে আপনি উপার্জন করেন, মেহমানদারী রক্ষা করেন, লোকদের বিপদে-আপদে তাদের সাহায্য করে থাকেন, এজন্যে আল্লাহ কখনই শয়তানদের আপনার উপর জয়ী বা প্রভাবশালী করে দেবেন না ।
কোন অমূলক চিন্তা-ভাবনা নেই যে, আল্লাহ আপনাকে আপনার জাতির লোকজনের হেদায়েতের কার্যের জন্যেই বাছাই করে নিয়েছেন।” হযরত খাদীজার এ সান্ত্বনা বাণী রাসূলে করীম (স) এর মনের ভার অনেকখানি লাঘব করে দেয়।
আর এ ধরনের অবস্থায় প্রত্যেক স্বামীর জন্যে তার প্রিয়তম ও সহানুভূতিসম্পন্ন স্ত্রীর আন্তরিক সান্ত্বনাপূর্ণ কথাবার্তা অনেক কল্যাণ সাধন করে থাকে । হুদায়বিয়ার সন্ধিকালে যখন মক্কা গমন ও বায়তুল্লাহর তওয়াফ করা সম্ভব হল না, তখন রাসূলের সঙ্গে অবস্থিত চৌদ্দশ সাহাবী নানা কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন
এ সময়ে রাসূল (স) তাদেরকে এখানেই কুরবানী করতে আদেশ করেন । কিন্তু সাহাবীদের মধ্যে তার এ নির্দেশ পালনের কোন আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না এ অবস্থা দেখে রাসূলে করীম (স) বিস্মিত ও অত্যন্ত মর্মাহত হন ।
তখন তিনি অন্দরমহলে প্রবেশ করে তাঁর সঙ্গে অবস্থানরত তাঁর স্ত্রী হযরত উম্মে সালমা (রা)- এর কাছে সব কথা খুলে বললেন। তিনি সব কথা শুনে সাহাবাদের এ অবস্থার মনস্তাত্ত্বিক কারণ বিশ্লেণ করেন এবং বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল! আপনি নিজেই বের হয়ে পড় ন এবং যে কাজ আপনি করতে চান তা নিজেই শুরু করে দিন। দেখবেন, আপনাকে সে কাজ করতে দেখে সাহাবিগণ নিজ থেকেই আপনার অনুসরণ করবেন এবং সে কাজ করতে লেগে যাবেন!”
পারিবারিক জীবনে স্ত্রী সংসারে কর্ত্রী-স্ত্রী দাসী নয়
সৃষ্টিগতভাবে নারী ও পুরুষের দেহে পার্থক্য বিদ্যমান। পুরুষ কষ্ট সহিষ্ণু দৈহিক শক্তিমান। পুরুষের তুলনায় নারীর শারীরিক শক্তি অল্প। এ কারণে পুরুষের কর্মক্ষেত্র সমস্যা সংকুল পরিবেশে।
নারী সংসারের ব্যবস্থাপনায় থাকবে। কোন কোন স্বামীর ধারণা হলো স্ত্রী সংসারের দাসী। এ ধরনের মনোভাব পোষণ করাও অপরাধ। কুরআন মজীদে এ পর্যায়ে বলা হয়েছেঃ স্ত্রীদের উপর পুরুষদের যে রকম অধিকার রয়েছে, ঠিক অনুরূপ সমান অধিকার নিয়ম উল্লিখিত হয়েছে। রয়েছে পুরুষদের উপর স্ত্রীলোকদের এবং তা সুস্পষ্ট প্রচলিত নিয়মানুযায়ী হবে।”
আয়াতটি সংক্ষিপ্ত হলেও এতে পারিবারিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি ও আর তা হচ্ছে এই যে, সকল ব্যাপারে ও বিষয়ে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদাসম্পন্ন। সকল মানবীয় অধিকারে নারী পুরুষেরই সমান, প্রত্যেকের উপর প্রত্যেকের নির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে।
তাই রাসূলে করীমও (স) বলেছেনঃ “নিশ্চয়ই তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমাদের হক-অধিকার রয়েছে এবং তাদেরও অধিকার রয়েছে তোমাদের উপর।” কেবল একটিমাত্র ব্যাপারে পুরুষ স্ত্রীর তুলনায় অধিক মর্যাদা পেতে পােের। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী পুরুষের সমান নয় ।
আর তা হচ্ছে তা-ই যা বলা হয়েছেঃ “পুরুষরা নারীদের ওপর কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব সম্পন্না” এই আয়াতাংশে।
এই একটি ক্ষেত্রে ছাড়া আর সব ক্ষেত্রেই নৈতিকতা, ইবাদত, আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা লাভ, কর্মফল প্রাপ্তি, মানবিক অধিকার ও সাধারণ মান-মর্যাদা এসব ব্যাপারেই স্ত্রীলোক পুরুষের সমান। অপর কোন ক্ষেত্রেই পুরুষকে স্ত্রীর তুলনায় শ্রেষ্ঠ এবং স্ত্রীকে পুরুষ অপেক্ষা নিকৃষ্ট মনে করা যেতে পারে না। আর সত্যি কথা এই যে, দুনিয়ার ব্যবস্থাসমূহের মাঝে একমাত্র ইসলামই নারীকে এ মার্যাদা দিয়েছে।
পুরুষকে পারিবারিক সংস্থা ‘সভাপতি’ করে দেয়া সত্ত্বেও ইসলামের লক্ষ্য হচ্ছে সব ব্যাপারে পারস্পরিক পরামর্শ করা ও পরামর্শের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ।
কেননা এরূপ হলেই পারিবারিক জীবনে শান্তি-সন্তুষ্টি মাধুর্য ও পরস্পরের প্রতি গভীর আস্থা ও নির্ভুলতা বজায় থাকতে পারে। দুগ্ধপোষ্য শিশুকে দুধ পান করাবার মেয়াদ হচ্ছে পূর্ণ দু’বছর।
এর পূর্বে যদি দুধ ছাড়াতে হয় তবে স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক পরামর্শ করে তা করতে পারে। নিম্নোক্ত আয়াতে একথাই বলা হয়েছেঃ “স্বামী-স্ত্রী যদি সন্তুষ্ট ও পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে দুধ ছাড়াতে চায়, তবে তাতে তাদের কোন গুনাহ হবে না।”
আয়াতটিতে একদিকে যেমন স্বামী-স্ত্রী, পিতামাতা উভয়েরই সন্তুষ্টি এবং পারস্পরিক পরামর্শের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, তেমনি অপরদিকে বিশেষভাবে স্ত্রী-সন্তানের মা’র সন্তুষ্টি ও তার সাথে পরামর্শের গুরুত্ব স্বীকার করা হয়েছে।
একেতো বাপ-মা দু’জনের একজনের ইচ্ছায় এ কাজ হতে পারে না বলা হয়েছে; দ্বিতীয়ত হতে পারে যে, মা’য়ের মত ছাড়াই বাবা নিজের ইচ্ছার জোরে শিশু সন্তানের দুধ দু’বছরের আগেই ছাড়িয়ে দিলো, আর তাতে মাও চিন্তান্বিতা হয়ে পড়লো এবং দুগ্ধপোষ্য শিশুর ক্ষতি হয়ে পড়লো ।
অতএব স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সন্তুষ্টি এবং সন্তানের পূর্বাপর অবস্থা সম্পর্কে পরামর্শ গ্রহণ অপরিহার্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সহজেই বুঝতে পারা যায়, দুগ্ধপোষ্য শিশুর দুধ ছাড়ানোর জন্যে যদি স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সন্তুষ্টি ও পরামর্শের এতদূর গুরুত্ব থাকতে পারে, তাহলে দাম্পত্য জীবনের অন্যান্য যাবতীয় ব্যাপারে সেই পরামর্শ ও সন্তুষ্টি গুরুত্ব নিশ্চয়ই অনেক বেশি হবে।
আর বাস্তবিকই যদি স্বামী-স্ত্রীর যাবতীয় কাজ পারস্পরিক পরমর্শ ও একে অপরের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রেখে সম্পন্ন করে, তাহলে তাদের দাম্পত্য জীবন নিঃসন্দেহে বড়ই মধুর হবে, নির্ঝঞ্ঝাট হবে, হবে সুখ ও শান্তিতে পরিপূর্ণ। পুরুষের জন্যে কর্মক্ষেত্র করা হয়েছে বাইরের জগত আর নারীর জন্যে ঘর।
পুরুষ বাইরের জগতে নিজের কর্মক্ষমতা প্রয়োগ করে যেমন করবে কামাই-রোজগার, তেমনি গড়বে সমাজ-রাষ্ট্র, শিল্প ও সভ্যতা। আর নারী ঘরে থেকে একদিকে করবে ঘরের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা, অপরদিকে করবে গর্ভ ধারণ, সন্তান প্রসব, লালন-পালন ও ভবিষ্যতের উপযুক্ত নাগরিক গড়ে তোলার কাজ।
এজন্যে নারীদের সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ “ এবং নারী-স্ত্রী তার স্বামীর ঘরের পরিচালিকা, রক্ষণাবেক্ষণকারিণী, কর্ত্রী।” স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্যের কথা নিম্নোক্ত হাদীসে আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। নবী করীম (স) ইশরাদ করেছেনঃ “তোমাদের জন্যে তোমাদের স্ত্রীদের উপর নিশ্চয়ই অধিকার রয়েছে, আর তোমাদের স্ত্রীদের জন্যেও রয়েছে তোমাদের উপর অধিকার।
তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে এই যে, তারা তোমাদের শয্যায় এমন লোককে স্থান দেবে না যাকে তোমরা পছন্দ কর না। তোমাদের ঘরে এমন লোককেও প্রবেশ করার অনুমতি দেবে না, যাদের তোমরা পছন্দ কর না বলে নিষেধ কর। আর তোমাদের উপর তাদের অধিকার হচ্ছে, তোমরা ‘তাদের ভরণ-পোষণ খুবই উত্তমভাবে বহন করবে!” স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্যসম্পন্ন এ দাম্পত্য জীবন যে কতদূর গুরুত্বপূর্ণ এবং এ জীবনে স্ত্রীর যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তা ব্যাখ্যা করে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী লিখেছেনঃ “দাম্পত্য জীবনের সম্পর্ক, সম্বন্ধ ও মিলনই হচ্ছে পারিবারিক জীবনের বৃহত্তম সম্পর্ক।
এ সম্পর্কের ফায়দা সর্বাধিক, প্রয়োজন পূরণের দৃষ্টিতে তা অধিকতর স্বয়ংসম্পূর্ণ। কেননা আরব অনারবের সকল পর্যায়ের লোকদের মধ্যে স্থায়ী নিয়ম হচ্ছে এই যে, স্ত্রী সকল কল্যাণময় কাজে-কর্মে স্বামীর সাহায্যকারী হবে, তার খানাপিনা প্রস্তুতকরণ ও কাপড়-চোপড় পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি করে রাখার ব্যাপারে সে হবে স্বামীর ডানহাত, তার মালসম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও তার সন্তানদের লালন-পালন করবে এবং তার অনুপস্থিতিতে সে তার ঘরের স্থলাভিষিক্ত ও দায়িত্বশীল।”
ঘরের অভ্যন্তরভাগের যাবতীয় ব্যাপারের জন্যে প্রথমত ও প্রধানত হয়েছে এক প্রকারের স্বাধীনতা । স্ত্রীই দায়ী। তারই কর্তৃত্বে যাবতীয় ব্যাপার সম্পন্ন হবে। এখানে তাকে দেয়া স্বামীর ঘর কার্যত তার নিজের ঘর, স্বামীর জিনিসপত্র ও ধন-সম্পদ স্ত্রীর হেফাযতে থাকবে। সে হবে তার আমানতদার, অতন্দ্র প্রহরী ।
কিন্তু স্বামীর ঘরের কাজকর্ম কি স্ত্রীকে তার নিজের হাতে সম্পন্ন করতে হবে? এ সম্পর্কে ইমাম ইবনে হাজমের একটি উক্তি দেখতে পাওয়া যায়। তিনি বলেছেনঃ “ স্বামীর খেদমত করা- কোন প্রকারের কাজ করে দেয়া মূলত স্ত্রীর কর্তব্য নয়, না বলেছেনঃ রান্না-বান্নার আয়োজন করার ব্যাপারে, না রান্না করার ব্যাপারে; না সূতা কাটা; কাপড় বোনার ব্যাপারে; না কোন কাজে।”
ফিকাহবিদগণ এর কারণস্বরূপ কেননা বিয়ের আক্দ হয়েছ স্ত্রীর সাথে যৌন ব্যবহারে সুখ ভোগ করার জন্যে। অতএব স্বামী তার কাছ থেকে অপর কোন ফায়দা লাভ করার অধিকারী হতে পারে না।” ইবনে হাজমের ‘মূলত কর্তব্য নয়’ কথাটি করে উপায় থাকে না । তাৎপর্যপূর্ণ । কেননা কোন কাজ মূলত কৰ্তব্যভুক্ত না হলেও অনেক সময় তা না
এজন্যে আমরা রাসূল (স) এর সময়কার ইসলামী সমাজে দেখতে পাই। স্ত্রীরা ঘরের যাবতীয় কাজকর্ম রীতিমত করে যাচ্ছে। নিজেদের হাতেই সব কাজ আঞ্জাম দিচ্ছে, ঘরের কাজকর্ম করতে গিয়ে নিদারুণ কষ্ট স্বীকার করছে, তবু সে কাজ ত্যাগ করেনি, কাজ করতে অস্বীকৃতিও জানায়নি। বলেনি আমি কোন কাজ করতে পারব না।
রাসূল তনয়া হযরত ফাতিমা (রা) ঘরের যাবতীয় কাজ করতেন, চাক্কি বা যাঁতা চালিয়ে গম পিষতেন, নিজ হাতে রুটি পাকাতেন এবং এ কাজে তাঁর খুবই কষ্ট হত । এজন্যে একদিন তিনি তাঁর স্নেহময় পিতার কাছে অভিযোগ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। হযরত আসমা (রা) তাঁর স্বামীর সব রকমের খেদমত করতেন।
তিনি নিজেই বলেছেনঃ “আমি আমার স্বামী জুবাইরের সব রকমের খেদমত করতাম।” রাসূলে করীম (স) এর যুগে ইসলামী সমাজের স্ত্রীরা স্বামীর খেদমত করতেন৷ এ কথা ঠিক। হযরত ফাতিমাও যখন নিজ হাতে যাঁতা চালিয়ে আটা তৈরি করতেন, আটা পিষে রুটি তৈয়ার করতেন ও আগুনের তাপ সহ্য করে রুটি পাকাতেন, তখন অপর যে কোন স্ত্রীর পক্ষে তা অকরণীয় হতে পারে না।
বরং সবার জন্যেই তা অনুসরণীয় । নিজের ঘরের কাজ করা কোন স্ত্রীর পক্ষেই অপমান কিংবা লজ্জার কারণ হতে পারে না। ইমাম মালিক এতোদূর বলেছেন যে, স্বামী বিশেষ ধনী লাক না হলে স্ত্রীর কর্তব্য তার ঘরের যাবতীয় কাজ যতদূর সম্ভব নিজের হাতে আঞ্জাম দেয়া॥ সে স্ত্রী যত বড় ধনী বা অভিজাত ঘরের কন্যাই হোক না কেন ।
সংসার জীবনে স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখবে স্ত্রী
স্বামী যখন স্ত্রীকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসবে, স্ত্রীর সকল প্রয়োজন পূরণ করবে, তখন স্ত্রীকেও এমন ভূমিকা পালন করতে হবে, যেন স্বামী তার স্ত্রীর ব্যবহারে সন্তুষ্ট হয়। স্বামী তার জন্যে কোন জিনিস নিয়ে এলে তার জন্যে সে শোকরিয়া জানাবে। এতে করে স্বামীর অন্তরে প্রেমের এক অনাবিল ভাবের সৃষ্টি হবে।
এজন্যে নবী করীম (স) বলেছেনঃ “ আল্লাহ্ তা’আলা এমন স্ত্রীলোকের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দান করবেন না, যে তার স্বামীর ভাল ভাল কাজের শোকরিয়া জ্ঞাপন করে না।” এ শোকরিয়া যে সব সময় মুখে ও কথায় জ্ঞাপন করতে হবে, এমন কোন জরুরী শর্ত নেই। শোকরিয়া জ্ঞাপনের নানা উপায় হতে পারে।
কার্জেকর্মে, আলাপে, ব্যবহারে স্বামীকে বরণ করে নেয়ার ব্যাপারে স্ত্রীর মনের কৃতজ্ঞতা ও উৎফুল্লতা প্রকাশ পেলেও স্বামী বুঝতে পারে। অনুভব করতে পারে যে, তার ব্যবহারে তার স্ত্রী তার প্রতি খুবই সন্তুষ্ট ও কৃতজ্ঞ এবং সে তার জন্যে যে ত্যাগ স্বীকার করছে, তা সে অন্তর দিয়ে স্বীকার করে । বুখারী শরীফের একটি হাদীসে এগারো জন স্ত্রীলোকের এক বৈঠকের উল্লেখ রয়েছে।
এতে প্রত্যেক স্ত্রীই নিজ নিজ স্বামী সম্পর্কে বর্ণনা দানের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করে এবং তার পরে প্রত্যেকেই তা পরস্পরের নিকট বর্ণনা করে। একজন স্ত্রী ` তার স্বামীর খুবই প্রশংসা করে । এ প্রশংসা করা যে অন্যায় নয় বরং অনেক সময় প্রয়োজনীয় তা এ থেকে সহজেই বোঝা যায় ৷
স্বামী বাইরে থেকে বাড়িতে এলে স্ত্রী সহাস্য বদনে স্বামীকে অভ্যর্থনা জানাবে। স্বামীর পোশাক পরিবর্তনে সাহায্য করবে, স্বামীর প্রয়োজনীয় জিনিস তাকে এগিয়ে দেবে। এতে করে স্বামীর হৃদয়ের জগতে এমন মধুভরা মলয় হিল্লোল বয়ে যায় যে, তার হৃদয় জগতের সব গ্লানি-শ্রান্তি-ক্লান্তিজনিত সব বিসাদ-ছায়া সহসাই দূরীভূত হয়ে যায়। স্বামী যত ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়েই ঘরে ফিরে আসুক না কেন এবং তার হৃদয়ে যত বড় দুঃখ, কষ্ট ও ব্যর্থতায়ই ভারাক্রান্ত হোক না কেন, স্ত্রীর মুখে অকৃত্রিম ভালবাসাপূর্ণ হাসি দেখতে পেলে সে তার সব কিছুই নিমেষে ভুলে যেতে পারে।
কাজেই যে সব স্ত্রী, স্বামীর সামনে গোমরা মুখ হয়ে থাকে, প্রাণখোলা কথা বলে না স্বামীর সাথে, স্বামীকে উদার হৃদয়ে ও সহাস্যবদনে বরণ করে নিতে জানে না বা করে না, তারা নিজেরাই নিজেদের ঘর ও পরিবারকে নিজেদেরই একমাত্র আশ্রয় দাম্পত্য জীবনকে ইচ্ছে করেই জাহান্নামে পরিণত করে, বিষয়িত করে তোলে গোটা পরিবেশকে ।
* রাসূলে করীম (স) এ কারণেই ভাল স্ত্রীর অন্যতম একটি গুণ হিসেবে উল্লেখ করেছেনঃ “স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দৃষ্টি পড়লেই স্ত্রী তাকে সন্তুষ্ট করে দেয় (স্বামী স্ত্রীকে দেখেই উৎফুল্ল হয়ে ওঠে)।” স্বামীর বাড়াবাড়ি ও ক্রুদ্ধ মেজাজ দেখতে পেলে স্ত্রীর খুব সতর্কতার সাথেই কাজ করা, কথা বলা উচিত।
এ অবস্থায় স্ত্রীরও বাড়াবাড়ি করা কিংবা নিজের সম্ভ্রম-মর্যাদার অভিমানে হঠাৎ করে ফেটে পড়া কোনমতেই বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। স্বামীর কাছে কিছুটা ছোট হয়েও যদি পরিস্থিতি আয়ত্তে রাখা যায়, তবে স্ত্রীর তাই করা কর্তব্য। কেননা তাতেই তার ও গোটা পরিবারের কল্যাণ নিহিত ।
কুরআনমজীদে আল্লাহ্ তা’আলা এ পর্যায়েই ইরশাদ করেছেনঃ “কোন স্ত্রী যদি তার স্বামীর বদমেজাজী ও তার প্রতি প্রত্যাখ্যান উপেক্ষা-অবহেলা দেখতে পায় আর তার পরিণাম ভাল না হওয়ার আশংকা বোধ করে, তাহলে উভয়ের যে কোন শর্তে সমঝোতা করে নেওয়ায় কোন দোষ নেই। বরং সব অবস্থায়ই
সমঝোতা-সন্ধি-মীমাংসাই অত্যন্ত কল্যাণময়।” এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ“ আয়াতে সাধারণ অর্থে কথাগুলো বলা হয়েছে। এভাবে বলার কারণে বোঝা যায় যে, যে সমঝোতার ফলেই উভয়ের মনের মিল হতে পারে, পারস্পরিক বিরোধ দূর হয়ে যায় তাই মোটামুটিভাবে অনেক উত্তম কাজ থেকে।” কিংবা তা অতীব উত্তম- বিচ্ছেদ হওয়া থেকে, বেশি উত্তম ঝগড়া-ফাসাদ
যৌন কামনা স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য
যৌন কামনা চরিতার্থ ও বংশ বৃদ্ধি, মানসিক প্রশান্তি ইত্যাদি বহুবিধ কারণেই মানুষকে দাম্পত্য জীবনে আবদ্ধ হতে হয়। পৃথিবীর কোন প্রাণীই এই কামনা হতে মুক্ত নয়। মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। নির্দিষ্ট একটা বয়সে পৌঁছে সকল নর-নারীর মধ্যে কামনা প্রবল হয়ে ওঠে। নর কামনা করে নারীকে নিবিড়ভাবে।
নারীও কামনা করে নরকে একান্ত আপন করে পরস্পর তারা মিলিত হতে চায়। ইসলামে এ যৌন মিলনকে কলুষতা মুক্ত ও অবাধ করার লক্ষ্যেই বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিবাহিত জীবনে মানুষ যেন নিঃশংক চিত্তে পূর্ণ তৃপ্তির সাথে যৌন কামনা চরিতার্থ করতে পারে। বিয়ে ব্যতীত যে কোন প্রকারেই হোক না কেন৷ যৌন কামনা চরিতার্থ করার অনুমতি ইসলাম দেয়নি।
দাম্পত্য জীবনে যৌন মিলনের ক্ষেত্রে ইসলাম মানুষকে পশু স্তরে নেমে যাওয়ারও অনুমতি দেয়নি। মিলন করতে হবে অবশ্যই একান্ত গোপনে। শিশু অবুঝ মনে করে তার সামনে মিলিত হওয়া যাবে না। পরস্পরে সম্পূর্ণ বস্ত্রহীন হওয়া যাবে না। পর্দার মধ্যে মিলিত হতে হবে।
মিলিত হবার পূর্বে অজু করতে হবে। মিলন শেষে অতিদ্রুত পাক-পবিত্র হতে হবে। স্বামীকে অবশ্যই স্ত্রীর কামনা পূর্ণ করতে হবে। স্ত্রী অসুস্থ বা অপারগ হলে স্বামীকে অবশ্যই সে দিকে দৃষ্টি দান করতে হবে।
যৌনমিলনকে আল্লাহর নেয়ামত মনে করতে হবে। সুস্থ নারীকে লক্ষ্য করে যৌন মিলন সংক্রান্ত কতিপয় হাদীস উল্লেখ করা গেল। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ “স্বামী যখন নিজের যৌন প্রয়োজন পূরণের জন্যে স্ত্রীকে আহ্বান জানাবে, তখন সে চুলার কাছে রান্না-বান্নার কাজে ব্যস্ত থাকলেও সে কাজে অমনি তার প্রস্তুত হওয়া উচিত।”
অপর হাদীসে এর চেয়েও কড়া কথা উল্লেখিত হয়েছে। বলা হয়েছেঃ “স্বামী যখন তার স্ত্রীকে নিজের শয্যায় আহ্বান করে (যৌন মিলনের উদ্দেশ্যে), তখন যদি সে সাড়া না দেয়॥ অস্বীকার করে, তাহলে ফেরেশতাগণ সকাল হওয়া পর্যন্ত তার উপর অভিশাপ বর্ষণ করতে থাকে।”
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ “হাদীসটি থেকে বাহ্যত মনে হয় যে এ ঘটনা যখন রাত্রি বেলা হয়, তখনই ফেরেশতারা অস্বীকারকারী স্ত্রীর উপর অভিশাপ বর্ষণ করে; কিন্তু আসলে কেবল রাতের বেলার কথাই নয়, দিনের বেলাও এরূপ হলে ফেরেশতাদের অভিশাপ বর্ষিত হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও যেহেতু যৌন মিলনের কাজ সাধারণত রাতের বেলাই সম্পন্ন হয়ে থাকে, এ জন্যে রাসূলে করীম (স) রাতের বেলার কথা বলেছেন।
মূলত এ কথা রাত ও দিন উভয় সময়ের জন্যেই প্রযোজ্য।” অপর এক হাদীসে এ কথাটি অধিকতর তীব্র ভাষায় উদ্ধৃত হয়েছে। তা এই॥ “যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ করে বলছি, যে ব্যক্তিই তার স্ত্রীকে যৌন মিলনের উদ্দেশ্যে তার শয্যায় ডাকবে, তখন যদি স্ত্রী তা অমান্য করে৷ যৌন মিলনে রাযী হয়ে তার কাছে না যায়, তবে আল্লাহ্ তার প্রতি অসন্তুষ্ট-ক্রুদ্ধ হয়ে থাকবেন যতক্ষণ না স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট হবে।” অনুরূপ আর একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ “স্ত্রী যদি তার স্বামীর শয্যা ত্যাগ করে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে, তবে যতক্ষণে সে তার স্বামীর কাছে ফিরে না আসবে, ফেরেশতাগণ তার উপর অভিশাপ বর্ষণ করতে থাকে।”
আর একটি হাদীস হচ্ছেঃ “ তিন ব্যক্তির নামায কবুল হয় না আকাশের দিকে উত্থিত হয় না তাদের কোন নেক কাজও । তারা হচ্ছেঃ পলাতক ক্রীতদাস। যতক্ষণ না মনিবের নিকট ফিরে আসবে, নেশাখোর, মাতাল । যতক্ষণ না সে সমস্ত ও প্রকৃতিস্থ হবে এবং সেই স্ত্রী, যার স্বামী তার প্রতি অসন্তুষ্ট৷ যতক্ষণ না স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট হবে।”
ইবনে জাওজীর ‘কিতাবুন্ নিসা’য় উদ্ধৃত অপর এক হাদীসে আরো বিস্তৃত কথা বলেছেন৷ হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেনঃ রাসূলে করীম (স) ‘মুবিফা’ ও ‘মুলিসা’র উপর অভিশাপ বর্ষণ করেছেন। ‘মুবিফা বলতে বোঝায় সেই নারী, যাকে তার স্বামী যৌন মিলনে আহ্বান জানালে সে বলেঃ “ এই শীগিরই আসছি।’
আর ‘মুগলিসা’ হচ্ছে সেই স্ত্রী, যাকে তার স্বামী যৌন মিলনে আহ্বান জানালে সে বলে ‘আমার হয়েছে’, অথচ প্রকৃতপক্ষে সে ঋতু অবস্থায় নয়।” অবশ্য এ ব্যাপারে স্ত্রীর স্বাস্থ্য, মানসিক অবস্থা ও ভাবধারার প্রতি পুরোপুরি লক্ষ্য রাখতে হবে। স্বামী যদি নিতান্ত পশু হয়ে না থাকে, তার মধ্যে থেকে থাকে মানুষত্বসূলভ কোমল গুণাবলী, তাহলে সে কিছুতেই স্ত্রীর মর্জী-মনোভাবের বিরুদ্ধে জোর-জবরদস্তি করে যৌন মিলনের পাশবিক ইচ্ছাকে চরিতার্থ করতে যাবে না ।
সে অবশ্যই স্ত্রীর স্বাস্থ্যগত মানবিক সুবিধা-অসুবিধার, আনুকূল্য-প্রতিকূলতা সম্পর্কে খেয়াল রাখবে এবং রেখেই অগ্রসর হবে। উপরে উদ্ধৃত হাদীসসমূহ সম্পর্কে ইমাম নববী লিখেছেনঃ “এ সব হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, কোন প্রকার শরীয়াতসম্মত ওযর বা কারণ ছাড়া স্বামীর শয্যায় স্থান গ্রহণ থেকে বিরত থাকা স্ত্রীর পক্ষে হারাম।” স্ত্রীর কোন শরীয়াতসম্মত ওযর থাকলে স্বামীকে অবশ্যই এ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
ফিকাহবিদগণ এজন্যে বলেছেন, অধিক মাত্রায় যৌন সঙ্গম যদি স্ত্রীর পক্ষে ক্ষতিকর হয় তাহলে তার সামর্থ্যের বেশি যৌন সঙ্গম করা জায়েয নয়।”
দাম্পত্য জীবনে তাক্কাওয়াদারী-পরহেজগারী
স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনকে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বলা যেতে পারে। কেননা দাম্পত্য জীবনের মাধ্যমেই পৃথিবীতে মহান আল্লাহ মানব বংশ বৃদ্ধি ঘটান, এ মানব শিশু মাতা-পিতার কোল হতেই শিক্ষা পেতে শুরু করে। শিশুর জীবনে পরবর্তীতে এ শিক্ষা অমর হয়ে থাকে । এ কারণে স্বামী স্ত্রীকে হতে হবে পরহেজগার।
স্বামী লক্ষ্য রাখবে এবং উৎসাহ প্রদান করবে স্ত্রীকে ইবাদাত বন্দেগী করার জন্যে । অনুরূপ স্ত্রীও উৎসাহ দেবে স্বামীকে। আর এই ধরনের স্বামী-স্ত্রীর কোলে যে সন্তান বড় হয়ে উঠবে, সে সন্তান নিঃসন্দেহে আল্লাহকে ভয় করতে শিখবে। মহানবী (দঃ) বলেন, “আল্লাহ্ যে পুরুষকে রহমত দান করবেন, সে রাতের বেলা জেগে উঠে নামায পড়বে এবং তার স্ত্রীকেও সেজন্য সজাগ করবে।
স্ত্রী ঘুম ছেড়ে উঠতে অস্বীকার করলে তার মুখে পানি ছিটিয়ে দেবে।” অনুরূপভাবে আল্লাহ্ রহমত দান করবেন সেই স্ত্রীকে যে, রাতের বেলা জেগে উঠে নিজে নামায পড়বে এবং সে তা স্বামীকেও সেজন্যে জাগাবে; স্বামী উঠতে না চাইলে মুখে পানি ছিটিয়ে দেবে।
অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ “ পুরুষ যখন তার স্ত্রীকে রাতের বেলা জাগাবে এবং দুজনেই নামায পড়বে। আলাদা আলাদাভাবে এবং দুরাকাত নামায একত্রে পড়বে, আল্লাহ্ এ স্বামী-স্ত্রীকে আল্লাহ্ ফিক্রকারী পুরুষ-নারীদের মধ্যে গণ্য করবেন।”